শক্তির স্তরবিন্যাস (সংক্ষিপ্তরূপ ) (Synopsis)
মাঘ, ১৩৬২



শক্তিসাধক পরমকে মাতৃভাবে দেখেন , কালী বা দূর্গা মাতৃভাবের বিকাশ , এই মাতৃভাবে পূজা করার একটা সুবিধা এই , মায়ের প্রতি কখনো কুপ্রবৃত্তি জাগেনা l শিব হচ্ছেন মহাব্যোম, এই শিবরূপী মহাব্যোমের ওপর কালী নৃত্যচঞ্চলা l আসলে মহাব্যোমের বুকে (Electron, Proton) মিলে (atom) সব নাচছে l কালী যে নিজেকে আবৃত রাখেন না সেই তত্ত্ব জানতে গিয়েই শৈব সাধক ব্যোম ব্যোম বলে চিৎকার করতে থাকে I কারণ ব্যোমেই তাঁর অবস্থান I শক্তি বা প্রকৃতি নারী মূর্তি নয় - এটি ভগবানের কর্মক্রিয়ার একটা symbol মাত্র I সাধনার প্রথম স্তরে সবাই শাক্ত I শাক্ত সাধনায় শ্মশান হল সেই প্রতীক যেখানে মনের সব বাসনা -কামনা পুড়ে ছাই হয়ে যায় এবং অনুভূত হয় শক্তির বিকাশ I এই অবস্থায় সাধক থাকে যোগযুক্ত I নিজের কর্মশক্তির উৎসবের সন্ধান পায় I এরপরই আসে বৈষ্ণবাবস্থা বা পরমের সঙ্গে পূর্ণমিলন I



শক্তির স্তরবিন্যাস
মাঘ , ১৩৬২

 

শাক্তেরা, শক্তিসাধকেরা পরমকে মাতৃভাবে দেখেন এবং ডাকেন I শক্তিতো ভিতরেই রয়েছেন; এই শক্তিকে আত্মিক সত্তায় উপলব্ধি করব, তারপর বিশ্বানুগ সত্তায় উপলব্ধি করব, তারপর বিশ্বর্ত্তীর্ণ সত্তায় পাব তার অনুভূতি -সেখানেই হল চরম উপলব্ধি -অধ্যাত্মজীবনের পরম পরিস্ফুর্ত্তি I শিব হচ্ছেন মহাব্যোম I আকাশে বাতাসে সকলখানেই এই মহাব্যোমের বুকে (electron, proton) মিলে (atom) সব নাচছে I ইহাই নৃত্যচঞ্চলা কালী -সৃষ্টির বীজময়ী সত্ত্বা ; ব্যোমের বুকে বিশ্বানুগ সত্তায় শক্তির যে চিরন্তন সৃষ্টির বিলাস উহার উপলব্ধিই শৈবাবস্থা I কালী উলঙ্গ কেন ? কারণ, তিনি তো সব সময়েই প্রসব করে চলেছেন I নিজেকে আবৃত করবার সময় বা অবকাশ তাঁর কোথায়? এই তত্ত্বকে জানবার মাধ্যমেই আসে সাধকের শৈবাবস্থা ; এই অবস্থায় শৈবসাধক ব্যোম ব্যোম বলে চিৎকার করতে থাকেন, কারণ ব্যোমে তাঁর অবস্থান I কিন্ত্ত এখানেও তিনি সম্পূর্ণ নন, এরপর অনন্ত মহাব্যোমে অনন্তের সঙ্গে মিশে গেলেই আসে বৈষ্ণব অবস্থা I বৈষ্ণব কথার অর্থই হল বিষ্ণু বা বিশ্বব্যাপ্ত সত্তায় নিমজ্জমান অবস্থা I উহাই বিশ্বত্তীর্ণ বা তুরীয় সত্তা I

শক্তি বা প্রকৃতি মেয়েমানুষ নয় ; প্রকৃতি নারী -মূর্ত্তিও নয় I এটি ভগবানের কর্মক্রিয়তার একটা Symbol মাত্র I শাক্তেরা কালী কালী বা দূর্গা দূর্গা বলেন কেন ? এর কারণ এই যে, এর দ্বারা হয় মাতৃভাবের বিকাশ; মায়ের নিকট কখনো কুপ্রবৃত্তি জাগে না, বরং কুপ্রবৃত্তির হয় নিরসন I দক্ষিণেশ্বরে একদিন মা সারদামণি ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের পদসেবা করছিলেন, আর ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ অপলক দৃষ্টিতে মা সারদামনির মুখপানে তাকিয়েছিলেন I তা দেখে মা সারদামনি ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে প্রশ্ন করেছিলেন - "তুমি আমার মুখের পানে তাকিয়ে কি দেখছ ? সারদামনির এই প্রশ্নের উত্তরে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বললেন - "ভবতারিণীর মন্দিরে যিনি ভবতারিণী হয়ে আছেন, নহবতে যিনি আমার গর্ভধারিণীরূপে আছেন আর এখানে যিনি আমার পদসেবা করছেন, এদের সকলকেই যে আমি একভাবেই দেখছি"I

সাধনার প্রথম স্তরে সবাই শাক্ত I নানাভাবে সবাই তাঁকেই ডাকে, এই শক্তিকে জানবার জন্য কেউ মাতৃভাবে, কেউ পুত্রভাবে, কেউ বন্ধুভাবে -শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য প্রভৃতি পঞ্চভাবের মাধ্যমে সাধনায় রত হয় I শাক্তেরাও বলে শ্মশান না হলে শক্তির উপাসনা হয় না; এর অর্থ এই যে, মনের সব বাসনা -কামনা পুড়ে ছাই হলে অর্থাৎ মনকে শ্মশান করলে তবেই তাতে শক্তির খেলা বিকাশ পায় I তখন সেই শ্মশানে শক্তি নৃত্য করেন I বিশ্বানুগ সত্তায় অনুভূত হল কৃতিময় অহং -এর বিকারশূন্য অবস্থা, তখন তিনি বুঝতে পারেন যে, আমি শক্তির পূর্ণ আয়ত্তে I এই শৈবাবস্থায় সাধক সর্বক্ষণ যোগযুক্ত থাকেন I এই অবস্থায় সাধক নিজেকে পরমের যজ্ঞের ক্রীড়ার পুতুল বলেই মনে করেন I সাধক তখন যোগমুক্ত হয়ে আত্মমগ্ন থাকেন I স্রোতের মুখে শেওলার মত -ঝড়ের মুখে তৃণের মত শুধু পড়ে থাকেন, আর থেকে থেকে দেখেন শক্তির বিলাস I এই ভাবে সাধক তাঁর কর্ম্মশক্তির উৎসের সন্ধান পান I তারপর সেই পরম উৎসে সমাহিত হয়ে পড়েন I এটিই বৈষ্ণবাবস্থা -অর্থাৎ পূর্ণ মিলন I এই অবস্থায় একুশদিনের বেশী দেহ থাকে না I এই স্তরে সাধক শক্তিকে উপলব্ধি করেন, কিন্ত্ত শক্তিকে নিয়ে খেলা করেন না; বিষ্ণুসত্তায় নিমজ্জমান অবস্থায় সকলেই বৈষ্ণব I ইহাই নিস্কল স্তর I এই বৈষ্ণবত্ত্ব হল ভাব I পরে বৈষ্ণবত্ব ভাব থেকে চ্যুত হয়ে জাতের পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে I কিন্ত্তু বৈষ্ণবত্ব কোন সম্প্রদায় হতে পারে না; ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন - যোগীরা যাঁকে ব্রহ্ম বলেন, ভক্তেরা যাঁকে ভগবান বলেন, আমি তাঁকেই কালী বলি I তাহলে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ কি বৈষ্ণবপদবাচ্য নন ? তাঁকে কি আমরা বৈষ্ণব বলতে পারি না ? যোগী, ভক্ত, শ্রীরামকৃষ্ণ তো একজনকেই ডাকেন I কারণ শক্তি ষড়ৈশ্বর্য্যময়ী এক একটি স্তর I শাক্ত, শৈব ও বৈষ্ণবত্ব -প্রত্যেকটি সাধনায় আত্মিক সত্তায় সাধক শাক্ত, বিশ্বানুগ সত্তায় শৈব I আর বিশ্বত্তীর্ণ সত্তায় বৈষ্ণব I শাক্ত না হয়ে কেউ শৈব হতে পারে না I আর শৈব না হয়ে কেউ বৈষ্ণব হতে পারে না I শাক্তই হউক, শৈবই হউক আর বৈষ্ণবই হউক -অষ্টদলের প্রবুদ্ধি ভিন্ন কেহই উপলব্ধ পুরুষ হতে পারেন না I এই জিনিষগুলোকে জানবার রয়েছে দুটি পথ, একটি যোগমার্গ আর অন্যটি উপাসনা -মার্গ I শাক্তই হউক, শৈবই হউক, আর বৈষ্ণবই হউক -এই দুটি পথের একটিতে না একটিতে যেতেই হবে I যোগমার্গ হল direct, আর উপাসনা -মার্গ হল indirect I সাধনায় যাহা ভক্তিমার্গ তাহা বাস্তবিক উপাসনা -মার্গ I ভক্তি হচ্ছে একটি ভাব, ভক্তি কোন পথ নয় I যে কোন একটি পথ চলতে চলতে চরম নিষ্ঠাময় যে ভাব তাহাই ভক্তি I নিষ্ঠা অর্থে অহং নাশ, উহা বস্তুতঃ ভাব ব্যতীত আর কিছুই নহে I ঐকান্তিক নিষ্ঠা বা অহং নাশ সাধনার চরম ফল I বস্তুতঃ শাক্ত, শৈব ও বৈষ্ণব সকলেই এক পরমের পথ -সন্ধানী I



 

ব্রাহ্মী চেতনা নিয়ে জগতে আসা
আবার এই চেতনা নিয়ে জগৎ থেকে
বিদায় নেওয়া - এইত অধ্যাত্ম সাধনা
- প্রেমানন্দ


* গীতাভারতী মিশনের দশম বার্ষিক উৎসবে প্রদত্ত ভাষণের মর্ম্মাংশ I