ভাবাদর্শ



গীতাভারতি মিশনের প্রতিষ্ঠাতা যোগাচার্য মহর্ষি প্রেমানন্দ তাঁর সাধনার ধারা সহজভাবে রূপায়িত করেছিলেন। ভগবদ অনুভূতির রসাস্বাদ ও নাদ (অনাহত ধ্বনি ) প্রত্যক্ষভূত করিয়েছেন অজপার মাধ্যমে, এই অজপা হল স্বতস্ফুর্ত প্রাণায়াম, সাংসারিক জীবনের কঠিন কঠোর সিঁড়িগুলি বেয়েই আধ্যাত্মিকতার চরমে পৌঁছে পরমানন্দ লাভ করেই মহর্ষি প্রেমানন্দ থেমে থাকেন নি , বৈদান্তিক অহংগ্রহ নাদ সাধনার ধারাকে সত্যের সন্ধানীর কাছে বিলিয়ে দিয়েছেন অকাতরে। মহাপ্রভু চৈতন্যদেব এসেছিলেন জগৎ মাঝারে অবিরত প্রেম বিতরণের জন্য। সে যুগেও অবতার মহাপুরুষ আচন্ডালে কৃষ্ণনাম শুনিয়েছেন।হরি কীর্তনের মধ্য দিয়ে পরমের সুখানুভূতি লাভ করিয়েছেন-হয়েছেন বিশ্বজনের গৌরাঙ্গ,মহাপ্রভু। প্রাণের ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব তাঁর বানীতেই লোকশিক্ষা দিয়ে গেলেন। অথচ বর্তমানে আমরা উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছেও লোভ আর পরশ্রীকাতরতায় মগ্ন এতটাই যে আমাদের প্রাণের মন্দিরের যিনি পরম পূজ্য, তাঁকে জাগ্রত করবার কোনো প্রচেষ্টাই যেন আমাদের নেই। আমরা তাই ঐশ্বর্যের মধ্যে ডুবে গিয়েও শান্তি বা সুখের সন্ধানে হতাশ হচ্ছি। পরমানন্দই যে মুখ্য তা ভুলতে বসেছি। অথচ এই ভারতভূমি মহাযোগীর পুণ্যস্পর্শে পবিত্র।

প্রসঙ্গত মহামানবদের জীবনে দুটি দিক আছে। একটি সাধন জীবন যা স্মরণ করে সাধারণ মানুষ জৈবী যন্ত্রণার হাত থেকে রেহাই পায়, অন্যটি সিদ্ধজীবন যার মহান স্পর্শে অধ্যাত্ম পিপাসু মানুষ পায় পরম শান্তি, পরম মুক্তি,মহাপ্রাণদের জীবনে যোগ বিভূতির ফলে কিছু অলৌকিক ঘটনা ঘটে। মানুষ সাংসারিক দুঃখ নিবারনের জন্য এই সকল মহাপ্রাণদের সরনাপন্ন হন,কিন্তু সত্যের অন্বেষণ করা সহজ হয় না। বিজ্ঞান মানুষকে করেছে বেগবান কিন্তু মানুষ হয়ে পড়েছে যন্ত্রবৎ; জীবন ধারন ছাড়া গূঢ় জীবন জিজ্ঞাসা আজ বহুদুরগামী। এই মর্ত্যে কেন এলাম এবং কোথা হতে এলাম আবার কোথায় আমাদের শেষ - এসবের চিন্তা কি জাগে না।

মহর্ষি প্রেমানন্দ যুগের যোগী হয়েই অবতীর্ন হয়েছিলেন। ৫০,৬০,৭০ এর দশকে মাহর্ষিজীর ভাবধারা বাংলাদেশের হাতিয়া ,ঢাকা , নারায়ণ গঞ্জ, নোয়াখালি এমনকি প্রত্যন্ত গ্রামে ও বিশেষ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। অধ্যাত্ম পিপাসু মানুষের জন্য গড়েছিলেন "গীতা ভারতী মিশন "। তাঁর ভাষায় - "গীতা ভারতীর আদর্শই হল ঐক্যানুভূতির ভিত্তিতে মহামানবের গোষ্ঠী গঠন করা, সাংস্কৃতিক সমন্বয়ের বাস্তব রূপ দান করা। আমি যা করে যাচ্ছি তা বিগত শতাব্দীর চরম অধ্যাত্মবাদীগণের আরদ্ধ কর্মের পরিপূরণ। তাঁদেরই কর্মবাসনা আমার কর্মে রূপায়িত হচ্ছে মাত্র। অবলুপ্ত রাজযৌগিক প্রণালিতে অধ্যাত্মসাধনা হচ্ছে পুনরায় প্রবর্তন। " তিনি সকল মুক্তিকামীকে তাঁর ' গীতা ভারতীতে ' আমন্ত্রন জানিয়েছিলেন। ১৩৭৯ - ২০ শে মাঘ তাঁর তিরোধান ঘটে তাঁর মহান আত্মা বিশ্বের কল্যাণ কামনায় সংকল্পবদ্ধ।,ধরনীর সাথে রেখেছেন যোগসূত্র,তাই এখনও বহমান তাঁর ভাবধারা সূক্ষ্নে দীক্ষার মাধ্যমে।

পূর্ববঙ্গে তাঁর মহাপ্রয়ানের পর তাঁর আদর্শকে বহন করেছিলেন তাঁরই সহধর্মিনী মা আনন্দময়ী এবং তাঁর পুত্রদ্বয়। মহর্ষিজীর সমকালেই পশ্চিমবঙ্গেঁর সঙ্গে সুন্দর সম্পর্ক সাধিত হয় চন্দননগরের প্রবর্তক সঙ্ঘের প্রাণপুরুষ মতিলাল রায়ের সঙ্গে। তাঁদের আত্মিক বন্ধনের সাক্ষী রয়ে গেছে তাঁদের মহামূল্যবান পত্র সমূহে - যা আধ্যাত্মিক মতাদর্শে ভরপুর। এরই প্রেক্ষাপটে গীতাভারতী মিশনের পুণ্যস্পর্শ পেয়েছিল পঃবঙ্গঁ।

মহর্ষি প্রেমানন্দ সুকৌশল কর্মপ্রণালীতে জাতি ধৰ্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ব্যক্তি মাত্রকেই নিজস্ব সংস্কার অনুযায়ী ভগবদতত্ত্বে অগ্রসর করিয়ে দেওয়ার লক্ষে ছিলেন অবিচল। গীতায় শ্রীকৃষ্ণ যে অধ্যাত্ম জিজ্ঞাসার সামনে অর্জুনকে পৌঁছে দিয়েছিলেন এবং অর্জুন যে পরমার্থ তত্ত্ব অনুধাবন করবার জন্য পিপাসার্ত হয়েছিল এবং গুরু শিষ্য নয় সখা কৃষ্ণের তুলে ধরার

সাহচর্যে পার্থের যে দিব্যজ্ঞান লাভ সেই যুগ যেন ফিরে পেয়েছিলো নারায়ণ গঞ্জের "গীতা ভারতী মিশন" ।

কেমন ছিল সেই স্বর্গলোক তার কথা বলতে গিয়ে ফিরে তাকাই সেই দিন গুলিতে। আসলে আজ যে মহান সাধকের জীবন চর্যাকে তুলে ধরার চেষ্টা করছি যিনি আজো সূক্ষ্নে তাঁর সিদ্ধ জীবনের মহাপ্রসাদ দিয়ে চলেছেন অবিরত প্রেম ধারায়,তাঁর অধ্যাত্ম অভিজ্ঞতা ধার করা কোনো শাস্ত্রের কথন নয়।

মহর্ষি প্রেমানন্দ সংসারে থেকেই নির্বানে অধিষ্ঠিত থাকতে পেরেছিলেন। যার দ্বারা নির্বান নামধেয় পরমসুখ পাওয়া যায়, যা পেলে আর জন্মমরণ ভোগ করতে হয় না তা আত্মতত্ত্ব জ্ঞান। আসলে লুপ্তপ্রায় সাধনার পুনরুজ্জীবন ঘটাতেই তাঁর আগমন। তিনি বরাবরই ছিলেন আত্মপ্রচার বিমুখ। পরমে পুর্ণ নিবেদিত হতে পেরেছিলেন বলেই গুরগিরির মোহ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পেরেছিলেন। তাঁর কাছে ভক্তপ্রাণ যাঁরা তাঁরা সন্তান সম। দীক্ষার ব্যাপারেও তিনি এনেছিলেন প্রচন্ড বিস্ফোরণ। দীক্ষা মানে প্রাণ প্রতিষ্ঠা, আধ্যাত্মিক নবজন্ম দান। গুরুর প্রাণশক্তিতে শক্তিবান হওয়া। মহর্ষি প্রেমানন্দের দূরদর্শী বিজ্ঞান ঘন দীব্য জীবনের আরেক বিশাল সাফল্য ধৰ্ম ও বিজ্ঞানের মধ্যে সুদৃঢ় রাখীবন্ধন। সাধন ভজনও যে , বিজ্ঞানানুগ কর্মকান্ড তা তিনি সুষ্টভাবে প্রমাণ করেছেন।

বিজ্ঞান জগতেও মনীষী আইনস্টাইন তাঁর Theory of relativity প্রমান করতে গিয়ে বলেছেন যে প্রত্যেক স্থুল সৃষ্টির মূলেই রয়েছে আলো (Energy) E =mc2 । একটা বস্তু যখন জ্বলে জ্বলে ক্ষয় হয় তখন আগুনের মধ্য দিয়ে বস্তুর শেষ রূপ তো আলোই দেখতে পাওয়া যায়। প্রকৃতি তত্ত্বের সূক্ষ চরমাবস্থাই হচ্ছে জ্যোতি ( আলো )। তাঁর প্রকাশ ভাষাতীত। এই জ্যোতিকেই সুক্ষ ইন্দ্রিয়ে আমরা ভগবদ্ রূপে প্রকাশ পেতে দেখি। যাঁকে জানাবার ভাষা নেই, উপমা নেই, তুলনা নেই। সেখানেই শুধুই ' আনন্দ ' আর আনন্দ। এই আনন্দের অনুভূতি সুক্ষ ইন্দ্রিয় মন দিয়েই উপলব্ধি করা যায়।

আলোতেও রয়েছে রূপগুনের সত্তা। বর্তমানে বিজ্ঞান তাঁর প্রমাণ দিয়েছে photon এর কথা বলে। হিন্দুদর্শনের পরমেশ্বর , ইসলামের খোদা এবং খ্রীষ্টানের God এই রূপগুনেরও অতীত। অনেকের ধারণা আধ্যাত্মিক জগতে নতুন কিছু পাবার জন্যই ঈশ্বর উপাসনা। আসলে নতুন কিছু পাওয়া নয় বরং যা হারিয়ে গেছে তাকে খোঁজা। এইজন্যই চাই সাধনা। সত্যকে উপলব্ধির জন্য দীক্ষা এবং তার জন্য আচার্য্যের প্রয়োজন। এই সত্য হল ব্রাহ্মী চেতনা।

ব্রাহ্মী চেতনা নিয়ে জগতে আসা, আবার এই চেতনা নিয়েই জগৎ থেকে বিদায় নেওয়া। কিন্তু ব্রাক্ষ্নী চেতনার জাগরণ ঘটানোর কাজটি করেন আচার্য। মহর্ষি প্রেমানন্দ তাঁর সাধনায় আনলেন বিস্ফোরণ। উত্তম আচার্যের দীক্ষা হল কুন্ডলিনীর জাগরণ। কুন্ডলিনী জাগ্রত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শিষ্যের হতে থাকে অতীন্দ্রিয় জগতের দ্বারোদঘাটন। আসলে মন্ত্রকে যিনি চৈতন্যময় করে শিষ্যের সংস্কার বুঝে দান করতে পারেন তিনি প্রকৃত আচার্য। অধ্যাত্ম সাধনা আর কিছু নয় - শুধু মনের রূপান্তর। মনের এই রূপান্তর আত্মাকে জানবার পথ করে দেয়। তবে আচার্যের দীক্ষাকে হতে হবে বিজ্ঞান ভিত্তিক যা মহর্ষি প্রেমানন্দ তাঁর ' গীতা ভারতী মিশনে ' সার্থক ভাবে স্ফরন ঘটিয়েছিলেন। দীক্ষা গ্রহণের অর্থ হলো ব্রাহ্মীজ্ঞান লাভের জন্য সুদৃঢ়ভাবে নিজের ভিত্তি প্রস্তুত করা। দীক্ষা সঠিক না হলে কখনই অনাহত ধ্বনি শ্রবণ করা যায় না। অধ্যাত্ম সাধনায় আত্মোপলব্ধির কর্মরূপ নাদসাধন প্রণালী কঠোর যুক্তিবাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত ভগবদ অনুভূতির রসাস্বাদ ও নাদ (অনাহত ধ্বনি )প্রত্যক্ষ ভূত হয়েছে অজপার মাধ্যমে। এই অজপা হল স্বতঃস্ ফূর্ত প্রাণায়াম। যাঁরা ব্রহ্ম সাধন করেন তাঁদের থাকে শ্বাস প্রশ্বাসের ওপর নিয়ন্ত্রণ। মহর্ষি প্রেমানন্দের সন্তান মাত্রই এই অজপার অংশীদার, স্বতঃস্ ফূর্ত প্রাণায়াম সম্ভব হয় একমাত্র ব্রহ্মজ্ঞ আচার্যের দাক্ষিণ্যে- আশীর্বাদে, ক্ষেত্র প্রস্তুত না হলে এই অজপায় দীক্ষা দেওয়া যায় না - একথা মহর্ষি প্রেমানন্দেরই সাধনার উপলব্ধজাত বাণী। এই দীক্ষা যে বিজ্ঞান সম্মত এই নিয়েই তাঁর অসামান্য রচনা ' দীক্ষা - বিজ্ঞান '। ধৰ্ম দর্শন যখন বিজ্ঞান দ্বারা চর্চিত হয় তখন সেখানে অলৌকিক ভাবনা লঘু হয়ে যায়।

'গীতা ভারতী মিশনের ' উদ্দেশ্য হল ক্রিয়া যোগ সহকারে প্রণবের প্রচার। গৃহী হয়েও কর্মময় জীবন যাপনের সাথে অনুচ্চার্য অদ্ধমাত্রা ধ্বনি (ওঁ - কার) বেজে চলেছে অহরহ। প্রকৃত আচার্য তিনিই যিনি নিজের শক্তিতে তাঁর সন্তানদের শক্তিমান করেন। জাগ্রত করেন ঘুমিয়ে থাকা কুলকুন্ডলিনী শক্তির এর জাগরণ ঘটে আচার্যের হাত ধরে। মুক্তি ব্যাকুল সন্তানদের হৃদমাঝারে প্রস্ ফুটিত হয় ব্রহ্মকমল।

আজ অধ্যাত্ম সাধনায় অতিবাস্তব প্রত্যক্ষ ও নিশ্চিত ফলপ্রদ নাদ সাধন প্রণালী ও বৈদান্তিক অহংগ্রহ উপাসনার ধারা সমাজস্মৃতি থেকে বিলুপ্ত। দেহকে আশ্রয় করে পরমের অবস্থান এবং পরমকে উপলব্ধি করতে হলে খুঁজে নিতে হবে নিজ অন্তঃপুর - এই প্রত্যক্ষ জ্ঞানে যে উপাসনা তাঁরই নাম ' অহংগ্রহ উপাসনা ' । "এখানে প্রতীক পূজার কোনো স্থান নেই। প্রতীকের ঊর্দ্ধেই পরমের প্রকাশ " (সত্য সংবীক্ষণ দ্রষ্টব্য মহর্ষি প্রেমানন্দ) নিস্ফলা প্রানায়াম নয়। পরমানন্দের স্পর্শে চৈতন্যের জাগরণ। নিজেকে জানা নিজেকে উপলব্ধি করাই সাধনা।

মহর্ষি প্রেমানন্দের মহাপ্রয়াণ ঘটে ২০শে মাঘ ১৩৭৯ (বঙ্গাব্দ), কিন্তু আজো সূক্ষ্নে দীক্ষা সংঘটিত হয়ে চলেছে। মহর্ষি প্রেমানন্দের বাণী ( "আমার কর্মধারয় সঠিক দীক্ষা ও শুদ্ধ যোগ কর্ম কৌশলে প্রত্যেকের মধ্যেই ৭২ ঘন্টায় অর্থাৎ তিন দিনের মধ্যে মনোলয় হয়ে সমাধি শক্তি স্ফুরিত হয়েছে " )

এই বাণী সর্বৈব সত্য এবং প্রমাণিত। রাজযোগী জন্মান্তরের ভরসায় থাকে না, তাঁর সহজ বা স্বভাবজাত অধ্যাত্ম কর্মের বলে অনন্ত জন্ম মৃত্যুর রহস্যকে নিজে করায়ত্ত করে নেয়। মিশনের কর্মধারায় সত্যের সন্ধানী ও মুক্তিকামী যে কোনো ব্যক্তি মাত্রই পরমাত্মার আলোতে আলোকিত হবেই।